রক্ত ও রক্তবাহ (Blood & Blood Vessels)

রক্ত ও তার উপাদান –

রক্ত তরল পদার্থ যা তৈরি হয় প্লাজমা (Plasma), লোহিত রক্ত কণিকা (Red Blood Corpuscles) এবং শ্বেত রক্ত কণিকা (White Blood Corpuscles) ও অনুচক্রিকা (Platelets) দিয়ে। এটি একটি জীবন্ত উপাদান এবং অস্বচ্ছ গাঢ় লাল রঙের তরল পদার্থ বিশেষ। রক্তের এই কণিকাগুলাে সমস্ত দেহের মধ্যে একদিকে যেমন শরীর কে বাইরের অণুজীব তথা ভাইরাস থেকে রক্ষা করে চলে অন্য দিকে রক্তের নিজস্ব বর্জ্য ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে যকৃৎ ও ফুসফুসে যায় তার বিশুদ্ধিকরণের জন্য অর্থাৎ কার্বনডাই অক্সাইড ও অক্সিজেন পরিবহন করে সেই সঙ্গেই পুষ্টি উপাদান ও দেহের প্রতিটি যায়গায় পৌঁছে দেয় ।

দেহ অভ্যন্তরে যে ধাতব পদার্থ থাকে অর্থাৎ লােহা, সােডিয়াম, পটাশিয়াম, তামা, আয়ােডিন ইত্যাদি, তার মধ্যে রক্ত কণিকায় থাকে লােহা। এখানে লােহার ভাগই বেশি, প্রায় ১৪ গ্রাম—১০০০ সি.সি.। মানুষের শরীরের মােট ওজনের ১২ বা ১৪ ভাগের ১ ভাগ রক্তের ওজন । গড় উত্তাপ ৯৮:৪° ফারেনহাইট। রক্তরস এবং রক্তকণিকা এই দুই উপাদান দিয়ে রক্ত তৈরি হয়। এমনিতে খালি চোখে রক্তরস দেখা যায় না। রক্ত বাইরে এলে জমাট বেঁধে যায়। জমাট বাঁধলে রক্তের আর আলাদা উপাদান টের পাওয়া যায় না। রক্তকে জমাট বাঁধতে না দিলে রক্তের মধ্যেকার রক্তকণিকা, রক্তরস এবং রক্তের তরল অংশকে চেনা যায়। একটি কাচের শিশিতে রক্ত নিয়ে তাতে সােডিয়াম সাইট্রেট সল্যুশন মেশালে রক্ত আর জমাট বাঁধতে পারে না। কিছুক্ষণ রেখে দিলে দেখা যাবে নিচে ঘন লাল অংশ জমে রয়েছে আর ওপরে দেখা যাবে সামান্য হলদে রঙের বেশ স্বচ্ছ তরল এবং মাঝে একটা পাতলা আস্তরণ (Blood Plasma)। ওপরের স্বচ্ছ তরলটাই হল রক্ত রস ।

রক্তকণিকা (Blood cell) –

রক্তকণিকা হয় দু’ধরনের লাল ও সাদা। একটি লােহিত কণিকা অন্যটি শ্বেত কণিকা। এছাড়াও আর এক ধরনের রক্তের কণিকা হয় যাকে বলা যেতে পারে ক্ষুদ্র কণিকা বা অনুচক্রিকা (Thrombocytes).

লোহিত কণিকা ( Red Blood Cells বা Erythrocytes) – লােহিত কণিকার জন্যই রক্তের রঙ লাল দেখায়। আর যে মূল উপাদানটির জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায় তা হলাে হিমােগ্লোবিন। গ্লোবিন, হিমােটিন এবং সামান্য মাত্রায় তামার সহযােগে রক্তের এই হিমােগ্লোবিন তৈরি হয়। খাদ্যের মধ্যেকার লৌহ পদার্থ এই হিমােগ্লোবিনের স্থিতিস্থাপকতায় সাহায্য করে। লােহার অভাব হলেও প্রয়ােজনীয় মাত্রায় হিমােগ্লোবিন তৈরি হতে পারে না। ফলে রক্তাল্পতাজনিত নানা রােগে মানুষ ভােগে। প্রসঙ্গতঃ শরীরে রক্ত সব সময় থাকে বলে এমন মনে করার কারণ নেই যে, একই রক্তকণিকা সব সময় রক্তের মধ্যে বয়ে চলেছে। এগুলাে চিরজীবি বা দীর্ঘজীবী মােটেই নয়। মানুষের শরীরে এরা ৩ থেকে ৪ মাস বেঁচে থাকে, তারপর নষ্ট হয়ে যায়। আবার তৈরি হয় রক্ত কণিকা। এভাবেই এদের মধ্যে অবিরাম জন্ম-মৃত্যুর খেলা চলে।

শ্বেত কণিকা (White Blood Cells বা Leukocytes) : মানবদেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও এর নানা প্রকার ভেদ আছে। যেমন, ইওসিনােফিলস (Eosinophils), ব্যাসােফিলস (Basophils), লিম্ফোসাইটস (Limphocytes), মনােসাইটস (Monocytes) ইত্যাদি।

শ্বেত কণিকার কর্মধারাকে আমরা অনেকটা পুলিস বা চৌকিদারের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এরা ক্রমাগত রক্তের ধারার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে চৌকিদারি করে। এরা রক্তের মধ্যে বা শরীরের মধ্যে জীবাণুর প্রবেশ করতে দেয় না বা জীবাণুর আক্রমণ হতে দেয় না। এগুলি প্রয়ােজনে এ্যামিবার মতাে গতি ও আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। শরীরে জীবাণু প্রবেশ করা মাত্র একযােগে এই শ্বেত কণিকারা তাদের আক্রমণ করে। কখনও কখনও পরাজিত জীবাণুরা শ্বেত কণিকাদের আহার্য বস্তুতে পরিণত হয়। এই লড়াইয়ের হারজিতের ওপর শরীরের রােগ-বালাই অনেকটা নির্ভর করে। লড়াইয়ে জীবাণুর সঙ্গে শ্বেত কণিকা পরাজিত হলে মানুষ রােগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জীবাণুকে পরাস্ত করলে শরীর নীরােগ থাকে। ফলে শ্বেত কণিকাকে সুস্থ ও সবল রেখে তাদের জীবাণুর সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের সহযােগিতা করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হয় এই শ্বেত কণিকা

যেন কোনাে অবস্থাতেই দুর্বল ও কর্মবিমুখ না হয়ে পড়ে। রক্ত কণিকার মতাে শ্বেত কণিকারাও চিরকাল বাঁচে না। রক্ত কণিকার চেয়েও এরা কম সময় বাঁচে। আবার নতুন করে কণিকার জন্ম হয়। প্রতিনিয়তই এদের সৃষ্টি ও ধ্বংসের খেলা চলছে।

ক্ষুদ্র কণিকা বা অনুচক্রিকা (Platelets বা Thrombocytes) : সংখ্যায় যেমন এরা প্রচুর, আকারেও হয় তেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। ১ কিউবিক মি. মি. রক্তে এদের সংখ্যা প্রায় ২.৫-৩.৫ লাখ। এরা একদিকে যেমন রক্তকে সুস্থ ও সজীব রাখতে সাহায্য করে অন্যদিকে রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এই জমাট বাঁধার কাজটা মানবদেহে খুব জরুরী। এরা পরস্পর মিলিত হয়ে রক্ত জমাট বাঁধার কাজে সাহায্য না করলে, কোনাে আঘাত, কাটা বা ছিদ্র থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরেই যেত। তবে জমাট বাঁধার সময়সীমা প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে এক রকম নয়। তাই কোনাে অপারেশনের আগে সাধারণতঃ ঠিক কতক্ষণ পরে রক্ত বন্ধ হচ্ছে এটা দেখে নিতে হয়। রক্ত ও কণিকার আরাে অনেক কাজ, প্রকারভেদ এবং ভূমিকা আছে। খুব বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়ে আমরা এখানে খুব সংক্ষিপ্ত একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করলাম।

রক্তবাহ –

ধমনী (Artery) ও শিরা (Vein)

ধমনী ও শিরার কথা একসঙ্গে না বললে আলােচনার অসুবিধা হতে পারে, কারণ উভয়ের কাজের সঙ্গে একটা পারম্পর্য আছে। আবার একে অন্যের ওপর বেশ খানিকটা নির্ভরশীলও বটে। আর উভয়েরই হেড কোয়ার্টার হলাে হৃৎপিণ্ড। প্রধানতঃ ধমনী ও শিরা দুটোরই কাজ হলাে রক্ত বহন করা। তবে তফাত হচ্ছে ধমনী বিশুদ্ধ রক্ত বহন করে, শিরা অশুদ্ধ রক্ত। প্রতিনিয়ত যে সব ছােট বড়, মােটা পাতলা, সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম বিভিন্ন রক্তবাহী নালী দিয়ে অণুদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ডে আসে এগুলিকে বলে শিরা। আর যে সব রক্তবাহী নালী নিয়ে বিশুদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে বেরিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশে এবং মস্তিষ্কে ছড়ায় তাদের বলে ধমনী। এক কথায় শিরা অশুদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ডে নিয়ে আসে আর ধমনী বিশুদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে নিয়ে যায়। সুতরাং এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে হপিণ্ড রক্ত বিশুদ্ধিকরণের একটা বড় কাজ করে। হৃৎপিণ্ডে অপরিশুদ্ধ রক্ত এলে (রঙ কালচে) হৃৎপিণ্ড তা পালমােনারি আর্টারির সাহায্যে ফুসফুসে পাঠায়। সেখানে নিঃশ্বাসের অক্সিজেনের দ্বারা সেই রক্ত পরিশুদ্ধ হয়। এরপর আবার সেগুলাে পালমােনারি শিরা দিয়ে হৃৎপিণ্ডে ফিরে যায় এবং ধমনী সেগুলাে বয়ে নিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত শরীরের মধ্যে এই কাজ চলে।

হৃৎপিণ্ডের বিশুদ্ধ রক্ত প্রধান ধমনী বা এ্যাওটা (Aorta) এবং আরও কিছু ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র-যাকে বলে ধমনীর কৌশিক নালী (Artery Capillaries) হয়ে শেষ পর্যন্ত ক্যাপিলারী ধমনীতে এসে পৌঁছায়। এই ক্যাপিলারী ধমনী সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জালের মতাে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বিশুদ্ধ রক্ত এভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়ে কোষ (Cell) ও তন্তু (Tissue)দের প্রয়ােজনীয় খাদ্য ও অক্সিজেনের যােগান দেয়। এরপর কোষ ও তন্তুর পরিত্যক্ত দূষিত পদার্থ ও কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অশুদ্ধ কালচে রক্ত গিয়ে প্রবেশ করে শিরার কৌশিক (Vein Capillaries) জালে। তার পর সেই অপরিশুদ্ধ রক্ত বিভিন্ন শিরা-উপশিরা হয়ে হৃৎপিণ্ডে পৌছায়। ধমনীর যেমন ছােট-বড়, প্রধান-অপ্রধান, মােটা-পাতলা, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম, শাখা-প্রশাখা ও উপশিরা আছে, শিরারও তেমনি বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও উপশিরা আছে। তুলনায় ধমনীর থেকে শিরার গায়ের ত্বক বা আবরণ পাতলা।

প্রসঙ্গতঃ আরও একটা কথা বলা প্রয়ােজন যে, দেহ-অভ্যন্তরে ধমনীগুলাে যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে শিরাগুলাে আরম্ভ হয়েছে সেখান থেকে। ধমনীর শেষ বলতে তার সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম (এত সূক্ষ্ম যে তার কয়েকটি মিলে একটি চুলের সমান হয়) শাখা-প্রশাখা এবং ক্যাপিলারী ধমনীর কথাও ধরে নিতে হবে আবার শিরার শুরু বলতে শিরার জালও এর মধ্যে আছে। এই শিরার জাল বা Vein Capillaries দিয়ে যাত্রা শুরু করে উপশিরা-শিরা হয়ে তবে অপরিশুদ্ধ রক্ত
হৃৎপিণ্ডে আসে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।